মাঠের বাইরের মেসি: নীরবতায় উচ্চারণ এক মহত্ত্বের কবিতা

Jun 10, 2025 - 22:46
Jun 11, 2025 - 01:53
 0
মাঠের বাইরের মেসি: নীরবতায় উচ্চারণ এক মহত্ত্বের কবিতা

আন্তঃবাণী স্পোর্টস ডেস্কঃ

 প্রজন্মের সেরা দুই ফুটবল জাদুকর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং মেসি। আমরা জানি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কেমন উদার হৃদয়ের মানুষ—তার দানশীলতা, দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা প্রায়শই উঠে আসে সংবাদে, আলোচনায়। কিন্তু লিওনেল মেসি? মাঠে দুরন্ত ড্রিবল, চোখ ধাঁধানো গোল আর ট্রফিতে ভরপুর ক্যারিয়ারের পেছনে যে রয়েছে এক নীরব, গম্ভীর, কিন্তু অবিশ্বাস্যরকম মানবিক এক চরিত্র—তা কি আমরা জানি?

চলুন, আজ একবার সেই মেসির কথা বলি, যে গোলের পর আকাশের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা জানায়, কিন্তু নিজের জীবনভর সংগ্রাম নিয়ে কখনও উচ্চবাচ্য করে না।

বিশ্বাসের আলোয় আলোকিত এক যাত্রীঃ

মেসির শরীরের মতোই তার বিশ্বাসও ছিল নিখুঁত ভারসাম্যে পরিপূর্ণ। আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরের এক সরল ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম নেওয়া এই কিংবদন্তি ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় মূল্যবোধে গড়ে উঠেছেন। তার গলায় ঝুলে থাকা রোজারি মালা শুধু অলঙ্কার নয়—এ এক নীরব আত্মিক সংযোগ, ঈশ্বরের প্রতি তার নিরবিচার আস্থার প্রকাশ।

মাঠে যখন সে গোল করে, তখন শুধুই বিজয়ের উল্লাস নয়—সে চোখ তোলে আকাশের দিকে। যেন বলে ওঠে, “তুমিই করেছো সবকিছু।”
তার এই বিশ্বাস কখনোই আত্মপ্রচারের হাতিয়ার হয়নি। কখনো ধর্ম নিয়ে জ্ঞান দেননি, বরং নিজ জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন—সত্যিকারের বিশ্বাস প্রকাশ পায় আচরণে, না বলা কথায়।

দানশীলতা যেখানে প্রচারবিমুখঃ

বর্তমান সময়ে যেখানে একজন তারকার দানশীলতা মানেই ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, ভিডিও ফুটেজ আর স্যোশাল মিডিয়ার হ্যাশট্যাগ—সেই জগতে মেসি এক ব্যতিক্রমী নক্ষত্র। Leo Messi Foundation প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি নিরবে গড়ে তুলেছেন সহানুভূতির এক সমান্তরাল জগত।

শিশুদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খেলাধুলা—যেখানে প্রয়োজন, সেখানেই ছুঁয়ে গেছে তার ফাউন্ডেশনের হাত। UNICEF-এর গুডউইল অ্যাম্বাসাডর হিসেবে তার অবদান নিঃশব্দ কিন্তু অনস্বীকার্য।

আফ্রিকার গ্রামে স্কুল গড়ে উঠেছে, হাসপাতাল পেয়েছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে পৌঁছেছে সহানুভূতির হাত। কিন্তু এসবের জন্য কখনোই সে মাইক্রোফোন ধরেনি।
তার মহত্ত্ব তাই শব্দে নয়, স্পর্শে।

যুদ্ধ যেখানে নিজের শরীরের সঙ্গেঃ

জীবনের সূচনায় যিনি লড়েছেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে—নিজের শরীর। মাত্র ১১ বছর বয়সে ধরা পড়ে Growth Hormone Deficiency—একটি রোগ যা তার শারীরিক বৃদ্ধি থামিয়ে দিয়েছিল। চিকিৎসা ব্যয় এতটাই বেশি ছিল যে পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে। আর্জেন্টিনার ক্লাবগুলো মুখ ফিরিয়ে নেয়, কারণ ‘ঝুঁকি’ নিতে চায়নি কেউ।

তখন এগিয়ে আসে বার্সেলোনা—একটি নেপকিনে লেখা চুক্তির মাধ্যমে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। অজানা ভাষা, অপরিচিত দেশ, মায়ের কোল ছেড়ে অন্য এক পৃথিবীতে গিয়ে নিজের স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে যে কিশোর দাঁড়িয়েছিল, সে-ই আজকের লিওনেল মেসি।

তিনি নিজেই একদিন বলেছিলেন,
"আমি শুধু খেলেছি, কখনো স্বপ্ন ভাঙতে দিইনি।"
এই এক বাক্যেই লুকিয়ে আছে তার জীবনের সারকথা।

নীরবতা যেখানে মহত্ত্বের উচ্চারণঃ

মেসির গল্প ট্রফিতে নয়, তার গল্প মাঠের বাইরের এক মৌন কবিতায়। যেখানে বিশ্বাস, দয়া আর দৃঢ়তায় তৈরি হয়েছে এক মানুষের পরিপূর্ণতা। সে কখনো উচ্চারণ করেনি “আমি মহান”, কিন্তু তার কাজ বলে দিয়েছে—মহানতা শব্দে নয়, হৃদয়ে স্থান করে নেয়।

লিওনেল মেসি সেই নীরব নায়ক, যে সবার চোখের সামনে থেকেও নিজেকে গোপন রেখেছে।
তার গল্পটা আমাদের শেখায়, “সফলতা শুধু গোল করা নয়, বরং মানুষ হয়ে ওঠাও এক মহান অর্জন।”