যে ভুল আবিষ্কারগুলো বদলে দিয়েছে আমাদের জীবন | Mistaken Inventions That Changed The World

ভুল থেকে জন্ম নেওয়া আবিষ্কার যেমন মাইক্রোওয়েভ, পেসমেকার, এক্স-রে, কোকা কোলা এবং সুপার গ্লু—যা আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে। জানুন এই অবিশ্বাস্য গল্পগুলো। নতুন নতুন তথ্যবহুল ডকুমেন্টারি পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আন্তঃবাণী।

Jul 14, 2025 - 17:17
 0

ভিয়েতনাম যুদ্ধে আর্মির হাতে এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ এসেছিল, যা তারা আহতদের ক্ষততে স্প্রে করলেই রক্তপাত সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যেত। ক্ষত যত গভীরই হোক না কেন, এই রাসায়নিক পদার্থ হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। আর অবাক করা বিষয় হলো, আজ এই রাসায়নিক পদার্থ প্রায় প্রতিটি ঘরেই রয়েছে।

আন্তঃবাণীর আজকের ভিডিওতে আমরা এমন কয়েকটা আবিষ্কারের কথা জানবো যা কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, বরং ভুলবশত আবিষ্কার হয়েছিল

প্রথমে আসি কোকা কোলার গল্পে।
কে জানত যে এক তলোয়ারের আঘাত একদিন পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত সফট ড্রিংক তৈরি করবে।
১৮৬৫ সালের কথা, ডা. পেমবারটন, যিনি আমেরিকান আর্মিতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ছিলেন, ব্যাটল অব কলম্বাসের সময় তাঁর বুকে তলোয়ারের আঘাত পান।  এই ক্ষত এত কষ্টের ছিল যে তিনি মরফিন নিতে শুরু করেন।
মরফিন তখন একটি আসক্তিকর ওষুধ ছিল, যা তখনই ব্যবহার করা হতো যখন কোনো ওষুধ কাজ করত না।
পেমবারটনের  ক্ষত ঠিক হয়ে যায়, কিন্তু তিনি মরফিনের নেশায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং এই নেশা থেকে মুক্তি চাইছিলেন।

তখন অ্যালকোহল ও কোকেনকে খারাপ মনে করা হতো না এবং যে কেউ কিনে ব্যবহার করতে পারত।
তিনি নিজের জন্য এমন এক ওষুধ তৈরি করেন, যাতে কোলা নাটস এবং ডামিয়ানা নামক উদ্ভিদের রস মেশানো হয় এবং তার সাথে কোকেন ও অ্যালকোহলের মিশ্রণ থাকে।
এটি অ্যালকোহলিক পানীয়ের পাশাপাশি ব্যথানাশক হিসেবেও কাজ করত। তিনি এর নাম দেন ফ্রেঞ্চ ওয়াইন কোকা
অর্থাৎ, একটি অভ্যাস ছাড়ার জন্য তিনি আরেকটি অভ্যাস গ্রহণ করেছিলেন।

প্রায় ২০ বছর পর, ১৮৮৬ সালে অ্যান্টি-অ্যালকোহলিজম ক্যাম্পেইন শুরু হয়, যেখানে অ্যালকোহল এবং কোকেনের বিরুদ্ধে আইন পাস হয়।  স্থানীয় ফার্মেসির মালিক পেমবারটনকে বলেন, এখন তাঁকে তাঁর ফ্রেঞ্চ ওয়াইন কোকা থেকে অ্যালকোহল এবং কোকেন বাদ দিতে হবে।  এজন্য ডা. পেমবারটন কিছু পরীক্ষা শুরু করেন।
তিনি কোলা নাটস এবং কোকা পাতার মিশ্রণ দিয়ে এক সিরাপ তৈরি করেন।  বিভিন্ন পরীক্ষা করে ফার্মেসির মালিককে তা স্বাদ নিতে দেন, কিন্তু ভুল করে একবার সিরাপে কার্বনেটেড পানি মিশিয়ে ফেলেন।
ফার্মেসির মালিকের তা এত ভালো লাগে যে তিনি এটি মাথা ব্যথার ওষুধ নয়, বরং রিফ্রেশিং ড্রিংক হিসেবে বিক্রি করার পরামর্শ দেন।

কারণ এটি কোকা এবং কোলা পাতার মিশ্রণ ছিল, তাই এর নাম দেওয়া হয় কোকা কোলা। শুরু হয়  রিফ্রেশিং ড্রিংক হিসেবে কোকা কোলার বিক্রি শুরু।
প্রথম কোকা কোলা মাত্র পাঁচ সেন্টে বিক্রি হয়েছিল এবং পেমবারটন জানতেন, একদিন এটি সারাদেশের পছন্দের পানীয় হবে।
কিন্তু নিজের অসুস্থতা এবং দেউলিয়াত্বের কারণে তিনি এই ড্রিংকের ফর্মুলা বিখ্যাত ব্যবসায়ী আসা গ্রিগস ক্যান্ডলার-এর কাছে মাত্র ২৩৮ ডলারে বিক্রি করে দেন।
আজ কোকা কোলার বাজারমূল্য ২৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা প্রায় ২২,১০০ বিলিয়ন টাকা

আপনি কি জানেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধে এমন এক রাসায়নিক ছিল, যা হাজার হাজার আহত সৈনিকের প্রাণ বাঁচিয়েছিল?
ডাক্তাররা প্রথম সাহায্য হিসেবে এই রাসায়নিক সৈনিকদের ক্ষততে স্প্রে করতেন, যা সঙ্গে সঙ্গে রক্তপাত বন্ধ করে দিত।
এই রাসায়নিক আর কিছু নয়, এটি হলো সুপার গ্লু

আজ এটি প্রতিটি ঘরে রয়েছে এবং মজার বিষয় হলো, সুপার গ্লুও ভুলবশত আবিষ্কৃত হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিকদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, তারা যখন বন্দুক থেকে গুলি চালাত, লক্ষ্য সঠিক স্থানে পড়ত না।
এই সমস্যার সমাধানের জন্য ইউএস আর্মিকে এক ধরনের স্বচ্ছ প্লাস্টিকের টার্গেট দরকার ছিল, যার ভেতর দিয়ে দেখা যাবে।

এর জন্য একদল রসায়নবিদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, যেখানে ডা. হ্যারি কুভারও ছিলেন।
তারা স্বচ্ছ প্লাস্টিক তৈরি করতে গিয়ে একটি এমন রাসায়নিক তৈরি করে ফেলেন, যা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি আঠালো ছিল।  এই রাসায়নিক তখন কোন কাজে আসেনি।

৯ বছর পর, ১৯৫১ সালে ডা. হ্যারি কুভার যখন কোডাক কোম্পানিতে কাজ করছিলেন, তখন জেট ইঞ্জিনের ক্যানোপি তৈরি নিয়ে এক পরীক্ষা চলছিল।  তখন ডা. হ্যারি আবার সেই রাসায়নিক সামনে আনেন, কিন্তু এবারও এর অত্যধিক সক্রিয়তার কারণে তা বাতিল হয়ে যায়।

হঠাৎ করে কোডাকের আরেকজন রসায়নবিদের রিফ্রেকটোমিটার ভেঙে যায়।  তখন হ্যারির মনে হয়, তার কাছে এর সমাধান আছে, যা আর কিছু নয়, সেই আঠালো রাসায়নিক।  তিনি সেই রাসায়নিক দিয়ে তা মুহূর্তেই জুড়ে দেন।

তখন হ্যারি বুঝতে পারেন, তার তৈরি রাসায়নিক কয়েক সেকেন্ডে স্থায়ীভাবে জিনিস জুড়ে দিতে পারে এবং এতে না তাপ লাগে, না কোনো চাপ।  ১৯৫৮ সালে এটি ইস্টম্যান ৯১০ নামে বাজারে বিক্রি শুরু হয় এবং পরে এর নাম রাখা হয় সুপার গ্লু

জিনিসপত্র জোড়ার পাশাপাশি সুপার গ্লু ব্যবহার করা হতে থাকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট শনাক্ত করতে।  সুপার গ্লু গরম করলে এর ধোঁয়া অদৃশ্য ফিঙ্গারপ্রিন্টের সঙ্গে বিক্রিয়া করে এবং সেটি দৃশ্যমান করে।  প্রথমদিকে সুপার গ্লু প্রথম সাহায্য হিসেবে ক্ষত থেকে রক্তপাত বন্ধ করতে ব্যবহার হতো।  তবে, দয়া করে এই পদ্ধতিটি ঘরে চেষ্টা করবেন না।

আরেকটা  জিনিস ভুলবশত আবিষ্কৃত হয়েছে তা হলো মাইক্রোওয়েভ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক ইঞ্জিনিয়ার পার্সি স্পেন্সার একটি রাডার কোম্পানিতে কাজ করছিলেন।  তার কাজ ছিল রাডার সেট তৈরির জন্য একটি ম্যাগনেট্রন বানানো।  একদিন তিনি একটি রাডার সেট পরীক্ষা করার সময় লক্ষ্য করলেন, তার পকেটে থাকা চকোলেট গলে যাচ্ছে।
তিনি বুঝতে পারলেন, রাডার থেকে আসা মাইক্রোওয়েভ রশ্মি তার পকেটের চকোলেট গলিয়ে ফেলেছে।
এরপর তিনি অন্যান্য খাবার যেমন পপকর্ন এবং ডিমের উপর এটি পরীক্ষা করেন এবং ফলাফলও একই রকম আসে।
 এই ভাবনা থেকে তিনি মাইক্রোওয়েভ ওভেন তৈরির দিকে অগ্রসর হন।

 ১৯৪৫ সালে, তিনি প্রথম মাইক্রোওয়েভ পেটেন্টের জন্য আবেদন করেন এবং ১৯৪৭ সালে প্রথম মাইক্রোওয়েভ ওভেন তৈরি করা হয়।  প্রথম মাইক্রোওয়েভের ওজন ছিল প্রায় ৩৪০ কেজি এবং উচ্চতা ছিল প্রায় ৬ ফুট
 আজ সেই মাইক্রোওয়েভ ওভেন আমাদের রান্নাঘরের অপরিহার্য একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 আপনি কি জানেন, পেসমেকারও ভুলবশত আবিষ্কৃত হয়েছিল?
১৯৫৬ সালে ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার উইলসন গ্রেটব্যাচ হার্টের জন্য একটি রেকর্ডিং ডিভাইস তৈরি করছিলেন।  হঠাৎ করে ভুল রেজিস্টর ব্যবহার করার কারণে সার্কিটটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে ইলেকট্রিক পালস তৈরি করতে থাকে।  তাকে শুনতে মনে হচ্ছিল, এটি মানুষের হৃদস্পন্দনের মতো।  তখন তার মাথায় আসে, যদি এই ডিভাইসটি হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা যায়, তাহলে হৃদরোগীদের উপকার হবে।  এরপর তিনি পেসমেকারের উপর কাজ শুরু করেন এবং দুই বছর পর প্রথম পেসমেকার ইমপ্লান্ট করা হয়। আজ পেসমেকার লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছে।

আপনি হয়তো জানেন না, এক্স-রে মেশিনও ভুলবশত আবিষ্কৃত হয়েছিল।  ১৮৯৫ সালে জার্মান পদার্থবিদ উইলহেলম রন্টজেন ক্যাথোড রে টিউব নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন।  তিনি লক্ষ্য করলেন, যখন টিউব চালু করা হয়, তখন পাশে রাখা ফ্লোরেসেন্ট স্ক্রিন জ্বলে ওঠে।  তার চারপাশে কোনো দৃশ্যমান আলো না থাকলেও স্ক্রিনটি আলোকিত হচ্ছিল।
তিনি পরীক্ষা করে দেখেন, অজানা এক রশ্মি স্ক্রিনটিকে আলোকিত করছে।  তিনি এই রশ্মিকে “X-Ray” নাম দেন।
পরে যখন তিনি তার স্ত্রীর হাতকে এক্স-রে করে ছবি তোলেন, তখন হাড়ের ছবি পরিষ্কার দেখা যায়।
 এই ভুলবশত আবিষ্কার চিকিৎসা ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটায় এবং রোগ নির্ণয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

আপনি যেটি প্রতিদিন সকালে ব্রাশ করার সময় ব্যবহার করেন, সেই টুথপেস্টও ভুলবশত আবিষ্কৃত হয়েছিল।
প্রাচীন কালে মিশরীয়রা দাঁত পরিষ্কার করার জন্য পাউডার ব্যবহার করত।  ১৮২৪ সালে পিই ব্রাশার নামের এক ডেন্টিস্ট এমন একটি মিশ্রণ তৈরি করেন, যা দাঁতের ক্ষয় রোধ করতে পারে।  কিন্তু তখনও তা পাউডার আকারেই ছিল।
১৮৭৩ সালে কলগেট কোম্পানি প্রথমবারের মতো টুথপেস্ট তৈরি করে এবং তা জারে বিক্রি করতে শুরু করে।
১৮৯২ সালে ডক্টর শেফিল্ড প্রথমবার টিউবের মধ্যে টুথপেস্ট প্যাক করে বিক্রি শুরু করেন।  যদিও এটি ভুলবশত নয়, তবে টুথপেস্টের আবিষ্কার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিশাল পরিবর্তন এনেছে।

দেখলেন তো, অনেক কিছুই ভুলবশত আবিষ্কৃত হয়েছে, যা আজ আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আপনার কাছে এই গল্পগুলো কেমন লাগল, কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না।


ভিডিওটি ভালো লাগলে লাইক ও শেয়ার করুন, এবং এমন তথ্যবহুল ভিডিও পেতে আন্তঃবাণী চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন। আন্তঃবাণী বাংলায় সারাবিশ্ব