সোভিয়েত স্পেস স্টেশন রক্ষার রোমাঞ্চকর অভিযান | Salyut 7 Mission
ঘণ্টায় ২৭,০০০ কিমি গতিতে উড়তে থাকা সাল্যুট-৭ স্পেস স্টেশন হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। কীভাবে সোভিয়েত কসমোনটরা এই বিপদজনক মিশন সম্পন্ন করে স্টেশনকে বাঁচালো? জানুন এই রোমাঞ্চকর সত্য কাহিনি। আরও ডকুমেন্টারি পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আন্তঃবাণী।
কল্পনা করুন, ঘণ্টায় ২৭,০০০ কিলোমিটার গতিতে উড়ে যাওয়া একটি বিশাল মহাকাশ স্টেশন হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। মহাকাশে সেটা যেন এক ভয়ঙ্কর টাইম বোমা।
না এটি কোনো সিনেমার গল্প নয়, এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাল্যুট-সেভেন স্পেস স্টেশনের বাস্তব ঘটনা।
সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি মহাকাশ স্টেশন তার কক্ষপথে থাকা অবস্থায় বৈদ্যুতিক ত্রুটি ঘটে এবং এর গ্রাউন্ড স্টেশনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে, যখন এই দুর্ঘটনা ঘটে তখন “সাল্যুট-সেভেন” নামের এই মহাকাশ স্টেশনে কোনো ক্রু মেম্বার ছিল না, কিন্তু বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সাথে সাথে এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং কক্ষপথ থেকেও সরে যায়। এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুতর সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি ছিল। ঘণ্টায় ২৭,০০০ কিলোমিটার গতিতে উড়ে যাওয়া একটি অ-নিয়ন্ত্রিত মহাকাশ স্টেশন কোনো টাইম বোমার চেয়ে কম ছিল না। এটিকে পুনরায় নিয়ন্ত্রণে আনার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু তারপর এমন কিছু ঘটে যা সোভিয়েত ইউনিয়নের গর্বকে আরও উঁচুতে নিয়ে যায়।
আন্তঃবাণীর আজকের গল্পে আমরা জানবো মহাকাশে ঘটে যাওয়া স্পেস স্টেশনের এই রোমাঞ্চকর গল্প।
আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কোল্ড ওয়্যার চলাকালে দুই দেশই নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য মরিয়া ছিল। এই শক্তি প্রদর্শনের লড়াই যেখানে কোটি কোটি ডলার ক্ষয় করেছিল, সেখানে এই কোল্ড ওয়্যারের সময় এমন কিছু আবিষ্কারও হয়েছিল যেগুলোর সুবিধা মানবজাতি আজও ভোগ করছে—যেমন ইন্টারনেট, জেট এয়ারক্রাফট এবং গ্লোবাল পজিশনিং স্যাটেলাইট (GPS)।
একে অপরকে দুনিয়ার চোখে হেয় করার জন্য এমন কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছিল যা মানুষ আগে কল্পনাও করতে পারেনি। আর যখন এই প্রসঙ্গ আসে, তখন স্পেস রেসের কথা প্রথমেই উঠে আসে। দুই দেশ এতটাই প্রতিযোগিতায় মগ্ন ছিল যে তাদের উদ্দেশ্য ছিল যত বেশি সম্ভব মহাকাশ মিশন লঞ্চ করা।
১৯৭০ সালে এই প্রতিযোগিতার মধ্যে উভয় দেশই একাধিক মহাকাশ স্টেশন লঞ্চ করে, যাদের উদ্দেশ্য ছিল মহাকাশে বিভিন্ন বিষয়ের উপর গবেষণা করা। সোভিয়েতের মহাকাশ স্টেশনগুলোর নাম ছিল “সাল্যুট”, আর আমেরিকার স্পেস প্রোগ্রাম ছিল “ল্যাব”। এই স্টেশনগুলো ছোট আকারের ছিল এবং একসাথে লঞ্চ করা হতো। মহাকাশে সীমিত সময় গবেষণার পর সেগুলোকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হতো।
প্রতিযোগিতা ছিল, কে বেশি সময় ধরে তাদের মহাকাশচারীদের মহাকাশ স্টেশনে রাখতে পারে। এমনকি নাম নিয়েও টানাপোড়েন ছিল। যুক্তরাষ্ট্র তাদের মহাকাশচারীদের “অ্যাস্ট্রোনট” বললে, সোভিয়েতরা সেই নাম ব্যবহার করতে চাইত না, বরং তারা তাদের মহাকাশচারীদের “কসমোনট” বলত।
১৯৮০ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রকে শিক্ষা দিতে ছোট স্পেস স্টেশনের পরিবর্তে একটি পূর্ণাঙ্গ বৃহৎ “মীর স্পেস স্টেশন” তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এর উন্নয়নে দেরি হচ্ছিল, আর তাদের “সাল্যুট-সিক্স” স্টেশন তার মেয়াদ শেষ করে ফেলেছিল। তাই মীর স্পেস স্টেশন লঞ্চের আগেই মহাকাশে নিজেদের উপস্থিতি ধরে রাখতে সোভিয়েত “সাল্যুট-সেভেন” লঞ্চ করে। সাল্যুট-সেভেনের বিশেষত্ব ছিল এতে সামনে এবং পেছনে ডকিং পোর্ট ছিল, যা দিয়ে কক্ষপথে থাকা অবস্থায় অন্য মহাকাশযান এতে এসে যুক্ত হতে পারত, ফলে ঘূর্ণন এবং সরবরাহ একসাথে করা সম্ভব হতো।
এপ্রিল ১৯৮২-তে “সাল্যুট-সেভেন” প্রোটন রকেটের মাধ্যমে লঞ্চ করা হয় এবং ১৩ মে-তে এতে ক্রু পাঠানো হয়। তারা সেখানে ২১১ দিন থেকে নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। তাদের কাজ ছিল একটি রেডিও স্যাটেলাইট স্পেস স্টেশন থেকে লঞ্চ করা, যা প্রথমবারের মতো ম্যানড স্পেস ভেহিকল থেকে লঞ্চ হওয়া কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট ছিল।
প্রথম বছর সফলভাবে গেলেও পরবর্তী সময়ে সমস্যার শুরু হয়।
৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩-তে কসমোনটরা একটি ফুয়েল ট্যাঙ্কে জিরো প্রেসার লক্ষ্য করে। এটি কোনোভাবেই স্বাভাবিক ছিল না, কারণ জিরো প্রেসার মানে ট্যাঙ্ক পুরো ফাঁকা। পরীক্ষা করে দেখা যায়, স্পেস স্টেশনের বাইরে ফুয়েল লিক হচ্ছে। স্পেসে অ্যাটমোসফেরিক প্রেসার না থাকায় সূক্ষ্ম ছিদ্র থেকেও সবকিছু শূন্যে টেনে নেওয়া শুরু করে, তাই ফুয়েল লিক রোধ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে ওঠে। কিন্তু কসমোনটদের কাছে পর্যাপ্ত টুলস ছিল না।
গ্রাউন্ড স্টেশন টুলস সরবরাহের জন্য সাল্যুট-সেভেন পর্যন্ত আরেকটি স্পেসক্রাফট পাঠায়। এটি গিয়ে সাল্যুট-সেভেনের সাথে যুক্ত হয় এবং এতে প্রয়োজনীয় টুলস ও অতিরিক্ত ক্রুও ছিল। এটি ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে জটিল রিপেয়ার, যেখানে কসমোনটদের বাইরে গিয়ে ওয়েল্ডিং করে ফুয়েল ট্যাঙ্কের ছিদ্র বন্ধ করতে হয়।
সাল্যুট-সেভেনের রিপেয়ার সফল হলেও নতুন বিপদ অপেক্ষা করছিল।
১৯৮৪-তে কসমোনটরা স্পেস স্টেশনকে অটো-পাইলট মোডে রেখে পৃথিবীতে ফিরে আসে। এরপর গ্রাউন্ড টিম রিমোটে স্টেশন মনিটর করছিল। কয়েকমাস পরে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫-তে হঠাৎ স্টেশনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পর্যবেক্ষন করে দেখা যায়, কোনো ইলেকট্রিক্যাল সার্জ হয়েছে। সেকেন্ডারি কমিউনিকেশন চালু করে যোগাযোগ পুনরায় স্থাপন করা হলেও পরে আরেকটি সার্জ হয় এবং সমস্ত যোগাযোগ চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্টেশন কক্ষপথ থেকেও সরে যায় এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
যুক্তরাষ্ট্র এ খবর পেয়ে এটিকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখে। তারা তাদের কার্গো শাটলের মাধ্যমে সাল্যুট-সেভেনকে ক্যাপচার করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে বিশ্বকে চমকে দিতে চায়। তবে সেই সময় সোভিয়েতের শাটল কার্যক্রম চলছিল, তাই তাদের আর কোনো উপায় ছিল না।
তাদের সিদ্ধান্ত হয়, দুই কসমোনটকে পাঠিয়ে ম্যানুয়ালি স্টেশন রিপেয়ার করার। এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ঘণ্টায় ২৭,০০০ কিলোমিটার গতিতে চলা স্পেস স্টেশনের সাথে ম্যানুয়ালি ডকিং করা, যা সামান্য ভুলে প্রাণনাশ ঘটাতে পারত।
৬ জুন ১৯৮৫-তে উদ্ধার অভিযানের জন্য সোইউজ স্পেসক্রাফট লঞ্চ করা হয়। এতে লেজার রেঞ্জ ফাইন্ডার, নাইট ভিশন গগলসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু নেওয়া হয়। দুই দিন কক্ষপথে থাকার পর কসমোনটরা সাল্যুট-সেভেনের কাছাকাছি পৌঁছায়। তারা প্রথমে লক্ষ্য করে সোলার প্যানেলগুলোর অবস্থান ঠিক নেই, যা ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম ব্যর্থ হওয়ার প্রমাণ। তারা লেজার রেঞ্জ ফাইন্ডার দিয়ে দূরত্ব মেপে ধীরে ধীরে স্টেশনের সাথে নিজেদের গতি ও অবস্থান মিলিয়ে ম্যানুয়ালি ডকিং করতে সক্ষম হয়।
ডকিংয়ের পর, দরজা খোলার সাথে সাথেই তীব্র ঠান্ডা বাতাসের ধাক্কা লাগে, ভিতরে অন্ধকার এবং সবকিছু বরফে ঢাকা ছিল। ভেতরের তাপমাত্রা মাইনাস ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। তারা উষ্ণ পোশাক পরে ভিতরে প্রবেশ করে এবং এয়ার কোয়ালিটি টেস্ট করে দেখা যায়, কার্বন মনোক্সাইডের মাত্রা অনেক বেশি, যা ইঙ্গিত করে ভিতরে আগুন লেগেছিল। শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল, তাই একসাথে দুইজন না থেকে পালাক্রমে একজন করে ভিতরে থাকত।
তাদের কাছে মাত্র ৮ দিনের খাবার-পানীয় ছিল, যা বাঁচিয়ে খেলে ১২ দিন পর্যন্ত টানতে পারত, কিন্তু সমস্যার কারণ খুঁজে বের করে মেরামত করতে তার চেয়ে বেশি সময় লাগতে পারত।
শেষে তারা দেখতে পায়, কেবল একটি সেন্সরের ত্রুটির কারণে পুরো স্টেশন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেন্সরটি ব্যাটারির চার্জিং রক্ষা করত, যা নষ্ট হওয়ায় ব্যাটারি চার্জ হতে পারেনি এবং পুরো সিস্টেম বন্ধ হয়ে যায়। সেন্সর পরিবর্তন ও সোলার প্যানেলের অবস্থান ঠিক করার পর স্টেশন পুনরায় সচল হয়। ইতিহাস সৃষ্টি করে কসমোনটরা পৃথিবীতে ফিরে আসে। স্যালুট সেভেন আরও এক বছর মিশনে ব্যবহৃত হয়।
এরপর “মীর” স্পেস স্টেশন লঞ্চ করা হয়। তবুও সাল্যুট-সেভেনকে স্পেসে রেখে দেওয়া হয়। মীরের ক্রু স্পেসক্রাফটের মাধ্যমে সাল্যুট-সেভেনে যায় এবং স্টেশন থেকে স্টেশনে স্থানান্তর করে নতুন রেকর্ড তৈরি করে।
কিন্তু ১৯৯১-এ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর ফান্ডিং সমস্যায় সাল্যুট-সেভেনের প্রতি মনোযোগ কমে যায়। শেষ পর্যন্ত এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রবেশ করে এবং দক্ষিণ আমেরিকার উপর ভেঙে পড়ে। এর মধ্য দিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ “সাল্যুট” স্পেস স্টেশনের অধ্যায় শেষ হয়। মহাকাশের ইতিহাসে সোভেয়েত ইউনিয়নের এই কর্ম উজ্জ্বল হয়ে লেখা থাকে।