কাশ্মীরের বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ

কাশ্মীরের পাহাড় আর নদীর মাঝে লুকিয়ে আছে এক টুকরো বাংলাদেশ! কীভাবে বাংলাদেশ নামের এই গ্রামে কাশ্মীরের মানুষ গড়ে তুলেছিল তাদের নতুন জীবন? কেন এই গল্প এখনো অনেকের অজানা? এই তথ্যচিত্রে জানুন কাশ্মীরের বুকে লুকিয়ে থাকা এক আশ্চর্য ইতিহাস।

Jul 3, 2025 - 12:56
 0  1

মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীর নাকি কাশ্মীর নিয়ে একদা বলেছিলেন-
‘আগর ফিরদৌস বার রু-য়ে জমিন অস্ত,
হামিন অস্ত-ও হামিন অস্ত-ও হামিন অস্ত!’

বাংলায় এই অমর পংক্তির অনুবাদ হলো, ‘এই পৃথিবীর বুকে কোথাও যদি স্বর্গ থেকে থাকে তাহলে তা এখানেই, তা এখানেই, তা এখানেই!’

যদিও এই লাইনগুলো আসলে কবি আমীর খসরুর লেখা, না কি অন্য কারও- তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু এই ‘জন্নত-ই-জাহান’ বা ‘ভূস্বর্গ’ খেতাবের সবচেয়ে বড় দাবিদার যে কাশ্মীর- তা নিয়ে বোধহয় বিন্দুমাত্র বিতর্ক নেই! 

আর সেই ভূস্বর্গের বুকে আজ চুয়ান্ন বছর ধরে এক টুকরো ‘বাংলাদেশ’ও যে বহাল তবিয়তে টিঁকে আছে এবং ক্রমশ বিখ্যাত হচ্ছে, বাংলাদেশী হিসেবে এই খবরও আমাদের মনে রীতিমতো রোমাঞ্চ জাগায়।

আন্তঃবানীর আজকের পর্বে আমরা জানবো কাশ্মীরের বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ এর গল্প। 

কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে ‘বাংলাদেশ’ নামের গ্রামটির অবস্থান। বান্দিপোরা জেলার এই গ্রামটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহওম মিঠা পানির লেক ‘উলার লেক’এর ঠিক কোল ঘেঁষেই। তবে নানা কারণে সোপোর-বান্দিপোরা রোড হামেশাই বন্ধ থাকে বলে প্রায়শই পুরো উলার লেক পরিক্রমা করে পৌঁছতে হয় সেই গ্রামে। রাজধানী থেকে পাড়ি দিতে হয় অন্তত সোয়াশো কিলোমিটার রাস্তা।

যেভাবে গ্রামটির নাম ‘বাংলাদেশ’ হয়েছিল সেই ইতিহাসটিও খুব চকমপ্রদ। ১৯৭১ সালের শীতে এক ভয়ঙ্কর অগ্নিকান্ড হয়েছিল ‘জুরিমাঞ্জ’ গ্রামে। সেই অগ্নিকান্ডে প্রায় পুরো গ্রামটাই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। গ্রামের এক পাশে উলার লেকের কোল ঘেঁষে অনেকটা ফাঁকা জমি ছিল, তখন সেখানেই সর্বস্ব-হারানো পরিবারগুলোকে নতুন করে ঘরবাড়ি তৈরি করে দেয় সরকার। এরপর প্রশ্ন ওঠে, নতুন এই জনপদটা তো জুরিমাঞ্জ থেকে বেশ খানিকটা দূরে– তো এই গ্রামের নাম কী দেওয়া হবে?

তখন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনা ও মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, সারা পৃথিবীর সঙ্গে অগ্নিকান্ডে সর্বস্ব-হারানো পরিবারগুলোও সে খবর রেডিওতে শুনেছিলো।

 নতুন করে সব শুরু করার স্পৃহা ও নবীন রাষ্ট্রকে সম্মান জানাতে নতুন গ্রামটির নামও দেওয়া হবে ‘বাংলাদেশ’- এমনটাই সেদিন স্থির করেছিলেন ওই জনপদের বাসিন্দারা।


বাংলাদেশের নামে গ্রামটির নামকরণের মূল আইডিয়াটা কার, এটা নিয়ে অবশ্য দুরকম ব্যাখ্যা আছে। কারো কারো মতে, সে সময়কার জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সৈয়দ মীর কাশিম পরামর্শ দিয়েছিলেন নতুন গ্রামটির নাম ‘বাংলাদেশ’ রাখা হোক, আর গ্রামবাসীরা সানন্দে সেটা মেনেও নিয়েছিলেন। আবার কারো কারো মতে, বাইরের কারও পরামর্শে নয়- গ্রামের তখনকার মুরুব্বিরা মিলেই নতুন জনপদের নাম বাংলাদেশ দিয়ে, তারা সদ্য স্বাধীন দেশটিকে স্বীকৃতি জানায়। দুটোর যে কোনও ব্যাখ্যাই সত্যি হতে পারে, তবে ‘বাংলাদেশ’ নামটা নিয়ে ওই গ্রামের আলাদা একরকম গর্ব আছে।

প্রথম দিকে নামটা মুখে মুখে চালু থাকলেও ২০১০ সালে বান্দিপোরা জেলার ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার অফিসও বাংলাদেশ নামটিকে নথিভুক্ত করেছে, এখন প্রায় ৭০টি পরিবারের সাড়ে তিনশো লোকের বসবাস সেখানে। বাংলাদেশ গ্রামের বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা অনেকটাই উলার লেক-নির্ভর। তারা কেউ লেকে মাছ ধরেন, কেউ আবার লেকের তীরে হাঁসের চাষ করেন। অনেকে আবার নৌকায় লেকের বুক থেকে তুলে আনেন ওয়াটার চেস্টনাট, জলের যে কাঁটাওলা ফসল অনেকটা বাংলার ‘পানিফলে’র মতো দেখতে। কাশ্মীরিরা স্থানীয় ভাষায় বলেন ‘সিংগারা’।

উলার লেকের বুকে পদ্মবন থেকে পদ্মের কন্দ বা ‘নদরু’ তুলে আনাটাও বাংলাদেশে অনেকেরই পেশা। এই নদরু দিয়ে তৈরি ‘ইয়াখনি’ নামে একটি পদ কাশ্মীরে খুবই জনপ্রিয়, আর বাংলাদেশের ‘নদরু’ এখন পাড়ি দিচ্ছে দিল্লি-মুম্বাই-ব্যাঙ্গালোরের বাজারেও।

এছাড়াও অসীম সম্ভবনাময় উলার লেককে ঘিরে পরিবেশ সংরক্ষণ ও পর্যটন প্রসারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘উলার কনজার্ভেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অথরিটি’, সরকারি অর্থায়ন আর বেসরকারি সহযোগীদের নিয়ে তারা নতুন করে আঁকছেন উলার লেকের চালচিত্র। 

জুরিমাঞ্জ-বাংলাদেশ-ওয়াতলাব গ্রামগুলোকে ঘিরে উলারের তীর ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে একটি আধুনিক বুলেভার্ড। ইতোমধ্যে লেকের বুক চিরে তৈরি হয়েছে প্রায় দুশো মিটার লম্বা একটি বোর্ডওয়াক, যেটির ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যাওয়া যায় একদম উলারের বুকে। 

‘বাংলাদেশ’ গ্রামের বাসিন্দারা এই বোর্ডওয়াকেরই নাম দিয়েছেন ‘ভিউপয়েন্ট’। ভিউপয়েন্ট খোলার পর থেকে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে তো বটেই, পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পর্যটক, প্রতি বছর ভিড় জমাচ্ছে বাংলাদেশে।

সব মিলিয়ে সুদূর উত্তর কাশ্মীরের এক প্রান্তে, সুবিস্তীর্ণ উলার লেকের তীরে একদা অপরিচিত ‘বাংলাদেশ’ যেন সম্প্রতি নতুন জীবন পেয়েছে। প্রতিবেশী দেশের নামে নামাঙ্কিত গ্রামটির নামডাক ছড়িয়ে পড়ছে দূর-দূরান্তে।

আর নামের কারনেই হাজার মাইল দূরে থাকা ঐ বাংলাদেশের বাসিন্দাদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা।