সাদা পোষাকে লাল সবুজ: টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ২৫ বছরের মহাকাব্য
২০০০ সালের এক নিস্তব্ধ দুপুরে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ইতিহাস রচিত হলো এক নতুন জাতির। সাদা পোশাক পরে মাঠে নামলো লাল-সবুজ পতাকার প্রতিনিধিরা। প্রতিপক্ষ ছিল ভারত — বিশ্ব ক্রিকেটের এক শক্তিশালী সম্রাট। বাংলাদেশ দল জানতো, তারা নতুন, দুর্বল, কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল অকৃত্রিম স্বপ্ন আর অদম্য সাহস।

আন্তঃবাণী স্পোর্টস ডেস্কঃ
২০০০ সালের এক নিস্তব্ধ দুপুরে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ইতিহাস রচিত হলো এক নতুন জাতির। সাদা পোশাক পরে মাঠে নামলো লাল-সবুজ পতাকার প্রতিনিধিরা। প্রতিপক্ষ ছিল ভারত — বিশ্ব ক্রিকেটের এক শক্তিশালী সম্রাট। বাংলাদেশ দল জানতো, তারা নতুন, দুর্বল, কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল অকৃত্রিম স্বপ্ন আর অদম্য সাহস।
সেদিন অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল ছিলেন দলের প্রতিভার মুখ। তিনি খেললেন এক ঐতিহাসিক সেঞ্চুরি — ১৪৫ রান। দলের প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ তুলে নিল ৪০০ রান — যা টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে অভিষেককারী দলের জন্য অন্যতম সেরা রেকর্ড। দলের অন্যান্য খেলোয়াড়দের মধ্যে হাবিবুল বাশার ৭১, খালেদ মাসুদ ৫০ ও শাহরিয়ার হোসেন ৪২ রান করেন। ভারতের ইনিংসে শচীন টেন্ডুলকার ১৫৭ এবং সাদাগোপন রমেশ ১০৩ রানের ঝড় তুলে। তবে বাংলাদেশের পক্ষে বল হাতে নাঈমুর রহমান দুর্জয় ছিলেন অসাধারণ, তিনি নেন ৬ উইকেট। যদিও বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৯১ রানে অলআউট হয়ে যায়, এবং ভারত ইনিংস ও ৯ রানে জয় লাভ করে, তবুও আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদার জয় ছিল সেদিন।
সেই প্রথম টেস্টে বাংলাদেশের একাদশে ছিলেন: আমিনুল ইসলাম (অধিনায়ক), শাহরিয়ার হোসেন, হাবিবুল বাশার, আকরাম খান, খালেদ মাসুদ (উইকেটকিপার), নাঈমুর রহমান দুর্জয়, মোহাম্মদ রফিক, খালেদ মাহমুদ, হাসিবুল হোসেন, মোহাম্মদ সেলিম ও এনামুল হক মনি। এই অভিষেক টেস্টটি ছিল জাতির ক্রীড়া ইতিহাসে এক গৌরবের সূচনা।
২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ছিল শেখার সময়। ৩৪টি টেস্টে জয় না পাওয়ার হতাশার মাঝে ছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০৫ সালের ঐতিহাসিক প্রথম জয়। এই সময়ের ক্রিকেটাররা শিখছিলেন কীভাবে ধৈর্য ধরে পাঁচ দিনের লড়াইয়ে টিকে থাকা যায়, কীভাবে পরাজয়কে পরবর্তী জয়ের শিখরে পরিণত করা যায়।
২০১০ সাল থেকে উঠে আসে নতুন প্রজন্ম—তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিমের নেতৃত্বে। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ড, ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। যদিও বিদেশে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা বড় চ্যালেঞ্জ থেকে যায়।
২০২০ সালের কোভিড-পরবর্তী সময়েও টেস্ট ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কমলেও বাংলাদেশ টেস্ট ফরম্যাটের প্রতি নিষ্ঠা বজায় রেখেছে। নিউজিল্যান্ড ও পাকিস্তানে দূর্লভ জয় পেয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। বর্তমানেও তরুণদের হাতে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ।
টি-টোয়েন্টি এসেছে ঝলক নিয়ে, ওয়ানডে এসেছে গৌরব নিয়ে। কিন্তু টেস্ট? টেস্ট থেকে এসেছে সম্মান, এসেছে শিক্ষার সৌন্দর্য, এসেছে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার পাঠ। বাংলাদেশের টেস্ট দল যেন তার জাতির প্রতিচ্ছবি—প্রথমে দুর্বল, তারপর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু এখনো পূর্ণতা পায়নি। আমরা এখন এক সন্ধিক্ষণে। আমাদের দরকার বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা, ঘরোয়া লিগ সংস্কারে সাহসী উদ্যোগ, দক্ষ পেস বোলারদের নির্মাণ, নেতৃত্বে স্থিতি এবং ক্রিকেট বোর্ডে পেশাদার মনোভাব। শুধু প্রতিভা দিয়ে নয়, শুধু আবেগ দিয়ে নয়—টেস্ট ক্রিকেটে বড় হতে হলে দরকার স্থায়ী বিনির্মাণ। যদি তা সম্ভব হয়, তবে আগামী ২৫ বছর শুধু কাব্য নয়—একটি মহাকাব্য হয়ে উঠবে।
পেস বোলিং ছিল বাংলাদেশের টেস্ট যাত্রায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। উপমহাদেশের মাটিতে স্পিন বলেই প্রধান অস্ত্র হলেও পেস বোলারদের জন্য ছিল কঠিন সময়। সেই বাধা ভেঙে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এক তরুণ নড়াইলের ছেলে—মাশরাফি বিন মুর্তজা। ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেকে তাঁর গতিময়তা ও আক্রমণাত্মক বলবাঁধন দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মুগ্ধ করে। যদিও ইনজুরির কারণে দীর্ঘকাল টেস্ট খেলতে পারেননি, তবুও প্রতিটি স্পেলে তিনি দিয়েছিলেন সংগ্রামের মন্ত্র। তিনি শুধু উইকেট নেননি, দলের সাহসও বাড়িয়েছেন। মাশরাফির হাত ধরে উঠে এসেছে রুবেল হোসেন, শফিউল ইসলাম, তাসকিন আহমেদ ও শরিফুল ইসলামদের মত পেসাররা। যদিও ধারাবাহিকতা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ, মাশরাফির সেই বুনে যাওয়া স্বপ্ন এখনও জ্বলজ্বল করছে অনেক তরুণের চোখে।
বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট ২৫ বছরে যা অর্জন করেছে তা কেবল পরিসংখ্যান নয়, বরং এক জাতির সংগ্রাম ও অধ্যবসায়ের গল্প। লাল-সবুজ পতাকার নিচে পাঁচ দিনের কঠিন লড়াইয়ে নামা ক্রিকেটাররা শুধু খেলোয়াড় নন, তারা দেশের প্রতিরোধের প্রতিমূর্তি। জয় মানে শুধু স্কোরবোর্ডে এগিয়ে থাকা নয়, সময়ের সঙ্গে নিজেকে গড়ে তোলার শক্তি। আগামী দিনে হয়তো বিশ্ব সেরা না হতে পারি, তবে লড়াইয়ের চেতনা আর সংগ্রামের মনোভাব বজায় থাকলে বাংলাদেশ কখনো হারবে না, শুধু তৈরি হবে।
এবি/সিএস