ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো: পর্তুগিজ ফুটবলের মহাকাব্যের নাম

তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা। তার গোল সংখ্যা পেরিয়েছে ১২৯-এর গণ্ডি। তার চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচও খেলেননি আর কেউ। এইসব পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, প্রতিটি গোল যেন ফুটবলের নতুন ব্যাখ্যা, প্রতিটি ম্যাচ যেন অধ্যবসায়ের এক এক প্রতিমা।

Jun 12, 2025 - 00:48
Jun 12, 2025 - 01:04
 0  12
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো: পর্তুগিজ ফুটবলের মহাকাব্যের নাম

স্পোর্টস ডেস্কঃ

দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় ফুটবলের আড়ালে থাকা এক ছোট্ট দেশের নাম—পর্তুগাল। যার গৌরব ছিলো এউসেবিওর কয়েকটি ঐতিহাসিক গোল আর একেকটি অসমাপ্ত স্বপ্ন। তবে সেই স্বপ্নে বাস্তবতার রঙ এনে দিয়েছেন একজন মানুষ। তার নাম ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তিনি শুধু এক ফুটবলার নন, বরং একটি দেশের ফুটবল চেতনার মূর্ত প্রতীক।

এইতো কয়েকদিন আগে, ৯ জুন ২০২৫, উয়েফা ন্যাশনাল লীগ-এর ফাইনালে শক্তিশালী স্পেনকে ২-১ গোলে হারিয়ে পর্তুগাল ইতিহাস গড়েছে তাদের তৃতীয় আন্তর্জাতিক শিরোপা জয় করে। এবং প্রতিবারের মতো এবারও যিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যিনি হয়ে উঠেছেন দলের আত্মা—তিনি রোনালদো। বয়স ৪০ ছুঁই ছুঁই, তবুও তার পায়ে যে জাদু, তা যেন সময়ের নিয়ম মানে না।

একটি নাম, একটি দেশ, একটি নতুন যুগের শুরুঃ

২০০৩ সালে যখন রোনালদো জাতীয় দলে প্রথমবার মাঠে নামলেন, তখন পর্তুগাল আন্তর্জাতিক ফুটবলে শিরোপাশূন্য একটি দল। ইউরো ২০০৪-এ ঘরের মাঠে ফাইনালে হেরে আবারও ভেঙে পড়ে স্বপ্ন। আর সেই ম্যাচেই মাঠ ছেড়ে কান্নায় ভেঙে পড়া ১৯ বছরের তরুণ রোনালদোকে দেখে ফুটবলবিশ্ব বুঝে গিয়েছিল—এই ছেলেটা থেমে যাবে না।

এরপর একে একে এসেছে সাফল্য। ইউরো ২০১৬-তে ফ্রান্সকে হারিয়ে প্রথমবার ইউরোপ সেরা হয় পর্তুগাল। রোনালদো সে ম্যাচে ইনজুরিতে পড়ে মাঠ ছেড়েও দাঁড়িয়ে ছিলেন কোচের পাশে, যুদ্ধরত সেনাপতির মতো নির্দেশনা দিচ্ছিলেন সতীর্থদের। ২০১৯ সালে উয়েফা ন্যাশনাল লীগ-এর প্রথম আসর জয় করে আরেকটি ইতিহাস গড়ে। আর সবশেষ ২০২৫ সালে, স্পেনের বিপক্ষে জয় তার নেতৃত্বকে দিলো পূর্ণতা।

অর্জনের শিখরে একাকী এক পুরুষঃ

রোনালদোর কৃতিত্ব শুধু পর্তুগালকে জেতানোতেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা। তার গোল সংখ্যা পেরিয়েছে ১২৯-এর গণ্ডি। তার চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচও খেলেননি আর কেউ। এইসব পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, প্রতিটি গোল যেন ফুটবলের নতুন ব্যাখ্যা, প্রতিটি ম্যাচ যেন অধ্যবসায়ের এক এক প্রতিমা।

তার হ্যাটট্রিক এসেছে বিশ্বের প্রায় সব বড় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে—স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, জার্মানি—কারো রক্ষা হয়নি। প্রতিবারই তার খেলায় ফুটে উঠেছে এক শিল্পীর সূক্ষ্মতা, এক যোদ্ধার দৃঢ়তা।

বিশ্ব ফুটবলে রোনালদোর প্রভাবঃ

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কেবল পর্তুগালের নয়, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের অনুপ্রেরণার নাম। তার কঠোর অনুশীলন, ফিটনেসের প্রতি নিষ্ঠা, পরিবারের প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং পেশাদারিত্ব—এসব মিলেই তিনি হয়ে উঠেছেন জীবন্ত কিংবদন্তি।

ক্লাব ক্যারিয়ারে তিনি খেলেছেন বিশ্বের সেরা ক্লাবগুলোর হয়ে—ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস, আল নাসর। প্রতিটি ক্লাবেই নিজের জাত চিনিয়েছেন। তবে জাতীয় দলের হয়ে যা করেছেন, তা শুধুই অনন্য।

> “তার ডান পা যেন বজ্রবিদ্যুৎ, তার মাথার বল যেন ঈগলের আক্রমণ, আর তার উপস্থিতি—একটি দলকে সাহস দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।”

রূপকথার শেষ না থাকা অধ্যায়ঃ

সময় বলে, সব কিছুরই শেষ আছে। কিন্তু রোনালদোর গল্প যেন সময়কেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। চল্লিশ ছুঁই বয়সেও তিনি জাতীয় দলে, ফিটনেসে উজ্জ্বল, পারফরম্যান্সে অপ্রতিরোধ্য। হয়তো ২০২৬ বিশ্বকাপ হবে তার শেষ নাচ, তবে তাতেও তিনি ইতিহাস গড়ার নেশায় মাঠে নামবেন, এ নিয়ে সন্দেহ নেই।

রোনালদো আমাদের দেখিয়েছেন কীভাবে কঠোর পরিশ্রম দিয়ে স্বপ্নকে বাস্তব করা যায়। তার প্রতিটি গোল যেন লিখে যায় এক নতুন কবিতা, তার প্রতিটি ম্যাচ যেন এক যুদ্ধ—যার শেষ দৃশ্যও সাহসে ভরা।

একটি নাম, যেটি ইতিহাস নয়, এক জীবন্ত মহাকাব্যঃ

রোনালদোর আগমনের আগে পর্তুগালের ছিল প্রতিভা, কিন্তু ছিল না সাফল্য। তার আগমনের পরে পর্তুগাল পেয়েছে তিনটি আন্তর্জাতিক শিরোপা, ফুটবল বিশ্ব পেয়েছে এক চিরস্মরণীয় নায়ক।

তাকে বলা যায় ফুটবলের অগ্নিপুরুষ—

যে নিজের শিখায় পুড়িয়ে ফেলেছে পরাজয়, আর আলো দেখিয়েছে একটি জাতিকে।”

আজ, যখন বিশ্ব রোনালদোকে সম্মান জানায়, তখন পর্তুগাল কেবল তার অধিনায়ককে নয়, তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সম্পদকে কুর্নিশ জানায়।

এবি/সিএস