ভারতের বিধ্বস্ত এয়ার ইন্ডিয়া ড্রিমলাইনার, বোয়িংয়ের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন প্রশ্ন!
ভারতের আহমেদাবাদে একটি মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট এআই১৭১, একটি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পরপরই বিধ্বস্ত হয়। ২০০৯ সালে সেবা শুরুর পর থেকে বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের প্রথম প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা।

বিশেষ প্রতিনিধিঃ ২০২৫ সালের ১২ জুন ভারতের আহমেদাবাদে একটি মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট এআই১৭১, একটি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পরপরই বিধ্বস্ত হয়। ২০০৯ সালে সেবা শুরুর পর থেকে বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের প্রথম প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন;২০৪টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার বিবরণ ও হতাহতঃ
লন্ডনের গ্যাটোইক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা ফ্লাইট এআই১৭১-এ ২৩০ জন যাত্রী এবং ১২ জন ক্রু সদস্য সহ মোট ২৪২ জন আরোহী ছিলেন। বিমানটি আহমেদাবাদের মেঘানির একটি আবাসিক এলাকায় বিধ্বস্ত হয়ে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বি.জে. মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি হোস্টেলের ক্যাফেটেরিয়াতে বিধ্বস্ত হয়। এর ফলে ভূমিতেও মারাত্মক রকমের হতাহতের ঘটনা ঘটে; যার মধ্যে ৫০ জন মেডিকেল শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, যাদের কমপক্ষে চারজন নিখোঁজ এবং দুজন গুরুতর অবস্থায় ছিলেন। রয়টার্স জানিয়েছে, দুর্ঘটনাস্থলের একটি ভবন থেকে কমপক্ষে ৩০টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
কাকতালীয়ভাবে এই দুর্ঘটনায় মাত্র একজন যাত্রী, যিনি একজন ব্রিটিশ পুরুষ নাগরিক, বেঁচে গেছেন এবং বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মতে, বিমানে থাকা ১.২৫ লক্ষ লিটার জ্বালানি থেকে সৃষ্ট তীব্র তাপের কারণে আরোহীদের কাউকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। নিহতদের মধ্যে গুজরাটের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানিও ছিলেন।
প্রাথমিক তদন্ত ও ফ্লাইটের গতিবিদ্যা
উড্ডয়নের পরপরই ফ্লাইট এআই১৭১ এর পাইলট বিপদ বুঝেই আহমেদাবাদ এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে একটি "মে ডে" কল করেছিলেন, যা একটি জরুরি অবস্থার ইঙ্গিত দেয়। এরপর বিমানটির কাছ থেকে আর কোনো বার্তা পাওয়া যায়নি। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে যে, উড্ডয়নের কয়েক সেকেন্ড পর ড্রিমলাইনারটি "প্রত্যাশিত উচ্চতা অর্জনে ব্যর্থ হয়" এবং "খুব নিচু দিয়ে, খুব ধীর গতিতে" শহরের উপর দিয়ে উড়েছিল, এরপর ঘটে সেই দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা। ফ্লাইটটি ক্যাপ্টেন সুমিত সাবারওয়াল (৮২০০ ঘণ্টা ওড়ার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন) এবং ফার্স্ট অফিসার ক্লাইভ কুন্ডারের (১১০০ ঘণ্টার উড্ডয়ন অভিজ্ঞতা) নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের প্রেক্ষাপট
এই দুর্ঘটনা বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের জন্য একটি বড় ধাক্কা। ২০১৩ সালে অতিরিক্ত গরম লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির কারণে ৭৮৭ ফ্লিটকে সাময়িকভাবে গ্রাউন্ড করা হয়েছিল। এপ্রিল ২০২৪ সালের একটি নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদনে একজন হুইসেলব্লোয়ার, একজন বোয়িং প্রকৌশলী দাবি করেছিলেন যে ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের কিছু অংশ "ইঞ্জিনিয়ারিং ত্রুটিপুর্ন” যা কয়েক হাজার ফ্লাইটের পর ভেঙে যেতে পারে।
বোয়িংয়ের ৭৩৭ ম্যাক্স সিরিজের সাথে চলমান সমস্যাগুলির (২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুটি প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা) এবং সম্প্রতি আলাস্কা এয়ারলাইন্সের একটি ম্যাক্স বিমান থেকে একটি দরজা খুলে পড়ার ঘটনার মধ্যে এই দুর্ঘটনা বোয়িংয়ের উৎপাদন গুণমান এবং সিকিউরিটি সিস্টেম নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
জরুরি প্রতিক্রিয়া ও ত্রাণ কার্যক্রম
ভারতের এই বিমান দুর্ঘটনার পরপরই ব্যাপক জরুরি পরিষেবা মোতায়েন করা হয়েছিল। ছয়টি এনডিআরএফ (জাতীয় দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া বাহিনী) দল, দুটি বিএসএফ (সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী) দল, ফায়ার ইঞ্জিন, অ্যাম্বুলেন্স এবং পুলিশ ইউনিট দ্রুত দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে। আহমেদাবাদ সিটি পুলিশ জনসাধারণের তথ্যের জন্য একটি জরুরি নম্বর জারি করে।
এয়ার ইন্ডিয়া এবং টাটা গ্রুপ (এয়ার ইন্ডিয়ার অপারেটর) ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের জন্য তাৎক্ষণিক ত্রাণ সহায়তা ঘোষণা করেছে। টাটা গ্রুপ প্রতিটি নিহত ব্যক্তির পরিবারের জন্য ১ কোটি টাকা (প্রায় $১,২০,০০০ মার্কিন ডলার) আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা আহতদের চিকিৎসার খরচও বহন করবে এবং বি.জে. মেডিকেল কলেজ হোস্টেল পুনর্নির্মাণে সহায়তা প্রদান করবে।
আন্তর্জাতিক সহায়তা ও প্রতিক্রিয়া
ভারতের এয়ারক্রাফট অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (AAIB) একটি আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে। মার্কিন ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড (NTSB) এবং যুক্তরাজ্যের এয়ার অ্যাকসিডেন্টস ইনভেস্টিগেশন ব্রাঞ্চ (AAIB) ভারতীয় নেতৃত্বাধীন তদন্তকে সহায়তা করার জন্য একটি এক্সপার্ট টিম পাঠাচ্ছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই দুর্ঘটনাকে "দুঃখজনক" বলে অভিহিত করেছেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি তার সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লসও "আহমেদাবাদের ভয়াবহ ঘটনা" সম্পর্কে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন । এই দুর্ঘটনা বৈশ্বিক বিমান চলাচল সুরক্ষা প্রোটোকল এবং প্রস্তুতকারকদের গুণমান নিয়ন্ত্রণের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।